২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর জীবিকার তাগিদে পা’ড়ি জমিয়েছিলাম মধ্যপ্রাচ্যের তেলস’মৃদ্ধ দেশ কাতারে। রাত সাড়ে ৮টায় আমিসহ প্রায় ১০০ যাত্রী নিয়ে একটি ফ্লাইট অবতরণ করে কাতারের হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। ইমিগ্রেশন শেষ করে লাগেজ নিয়ে বের হলাম। বাইরে বের হয়ে দেখলাম আমার প্রিয় একজন ভাই আমার জন্য অপে’ক্ষা করছে।
দেখা হতেই বুকে জ’ড়িয়ে ধরে কুশল বি’নিয়ম হলো। কুশল বিনিয়ম শেষে গাড়িতে ও’ঠলাম, রওনা হলাম কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। কর্মস্থলে পৌঁছে সহকর্মীদের সাথে শুভে’চ্ছা বিনিময় করলাম। শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে একজন সিনিয়র সহক’র্মী আমাকে কাজের বিভিন্ন বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিলেন। ১০ ডিসেম্বর ছিল আমার প্রথম কর্মদিবস।
২০১৫ সালের সেই দিন থেকে শুরু করে কর্মস্থলে সততা ও দ’ক্ষতার সাথে কাজ করছি। আজ আপনাদের সামনে তু’লে ধরার চেষ্টা করবো আমার প্রবাস জীবনের সুখ-দুঃ’খের কিছু বাস্তবমুখী কথা। কেমন গেলো দীর্ঘ ৭ বছর! প্রবাস জীবন আমাকে দিয়েছে অনেককিছু। আমাকে দিয়েছে ভা’গ্যের খোঁ’জে ঘরছাড়া একটি জীবন। দিয়েছে পরিবার থেকে অনেক দূরে স’রিয়ে। মা-বাবা, ভাই-বোনের শা’সন থেকে অনেক দূরে রেখেছে।
পরিবার থেকে দূরে সরে না থাকলে হয়তো বুঝতে পারতাম না কতটা ভালোবাসি আমার পরিবারকে। কত রাত আসে যায়, মা আর ফোন দেয় না। বলে না বাবা তুই কো’থায়? কখন আসবি? প্রবাস জীবনে প্রতি রাতে মায়ের সেই কথাটা ভেবে মনে মনে অনেক কেঁ’দেছি। মা-বাবা এখন আর আমাকে নিয়ে তেমন একটা চি’ন্তা করেন না। কারণ তাদের সেই ছোট্ট অ’গোছালো ছেলেটা আজ নিজেকে গু’ছিয়ে নিয়েছে।
যে ছোট্ট ছেলেটা ডিম কিংবা ভাত রান্না করতে পারতো না সেই ছোট্ট ছেলেটা আজ মাংস রান্না করতে পারে। মাকে বলেছি, ইনশাআল্লাহ দেশে এসে আপনাকে রান্না করে খাওয়াবো। মা তো ম’হাখুশি। প্রবাস জীবন আমাকে দিয়েছে এক অ’চেনা শহর। এক অচেনা শহরে মানুষ চেনায় ব্য’স্ত আমি। এখানে চলতে হয় মানুষের মন বুঝে। এখানে চলতে হয় সবার সাথে তাল মিলিয়ে। অনেক সময় বুঝেও না বোঝার ভা’ন করতে হয়।
দীর্ঘ ৭ বছরে ছয়বার কর্মস্থল বদ’লি হয়েছে আমার। বদলির পাশাপাশি কর্মস্থলে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনে দ্বিতীবার পদোন্নতি হয়েছে আমার। এখানে কেবল ব্যস্ততা আর ব্যস্ততা। মানুষ নামের ব্যস্ত একটা রোবট এখন আমি। রাত যতটায় ঘুমাই না কেন এর্লাম বেজে ওঠা মাত্রই ঘুমের বিদায়। প্রতিদিন ফজরের নামাজ আদায় করে কাজ শুরু করি। সেই সকাল থেকে শুরু করে দুপুর ১২টা পর্যন্ত।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে একটু বিশ্রাম নয়তো মা-বাবা কিংবা বন্ধু-বান্ধবের স’ঙ্গে কথা বলি। কথাবার্তা বলতে বলতে বিশ্রামের সময় শেষ। আবার ৩টা থেকে শুরু করে রাত ৯/১০টা পর্যন্ত। কোনোদিন যদি বেশি ক্লা’ন্ত হয়ে যাই তখন বিশ্রাম নিই। তার মাঝে আরেকটা টেনশন এসে বাসা বাঁ’ধে, বাড়িতে কথা না বললে তো সবাই চি’ন্তা করবে। প্রবাসে না এলে হয়তো বুঝতে পারতাম না সবাই আমাকে এত ভালোবাসে।
প্রবাস জীবনে সবচেয়ে দা’রুণ সময় কে’টেছে মহামারীতে। কর্মস্থলে একজনের করো’না’ভাইরা’স শনা’ক্ত হওয়ায় সবাইকে ক’রানো হয়েছিলো টেস্ট। নে’গেটিভ হওয়ার পরও কো’য়ারেন্টা’ইনে থাকতে হয়েছে একজন আ’ক্রা’ন্ত রোগী থাকার কারণে। হোম কো’য়ারেন্টা’ইনের ১৪ দিন আমার ভালো সময় কে’টেছে। তখন ভু’লতে চেষ্টা করেছি প্রবাস জীবনের অতীতের সব দুঃখ-কষ্ট। প্রবাস জীবনের অভি’জ্ঞতা থেকে বলছি, প্রবাস জীবন বড় ক’ষ্টের, তা বোঝার ক্ষ’মতা সবার নেই।
এই প্রবাস মানে সীমাব’দ্ধ জেলখানা, প্রবাস মানে ত্যা’গ, প্রবাস মানে পরিবারের ১০জনের সুখের জন্য নিজেকে বলি দেওয়া। আমার মতো এ প্রবাস জীবনে পরিবারের সুখের জন্য অনেকে কা’টিয়ে দিচ্ছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। পরিবারের অসচ্ছলতার কারণে অনেকে মৃ’ত্যুর আগ পর্যন্ত কা’টিয়ে দেয় প্রবাসে। অনেক প্রবাসীকে মৃ’ত্যুর পরও আ’র্থিক অ’সচ্ছলতার কারণে লা’শটা পর্যন্ত পাঠানো যায় না দেশে। দেশে যেতে এত বছর অপে’ক্ষায় থাকা মানুষটাকে শেষে বিদেশের মাটিতে দা’ফন করতে হয়। কথাগুলো কাতার থেকে লিখেছেন প্রবাসী মোহাম্মদ জোনাইদ।